top of page

শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর সম্বন্ধে বিতর্ক

শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর সম্বন্ধে বিতর্ক


—শ্রীশ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর


চারি বৎসর হইল, আমি প্রচারকার্য্য বন্ধ করিয়া কোন নির্জন গুহায় ভজন করিতেছিলাম। অদ্য কোন কোন বৈষ্ণবের অনুরোধে লোকালয়ে আসিয়া প্রথমেই একটী বিষয়সম্বন্ধে দুঃখ প্রাপ্ত হইলাম। শুনিলাম, কোন কোন আচার্য্যসন্তান সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর পৃথক্ মন্ত্রে উপাসনা ও তাঁহার জন্মদিনে উপবাসপূর্ব্বক ব্রতপালন নাই। এই ব্যবস্থাটী আচার্য্যসন্তানদিগের পক্ষে যোগ্য কিনা, ইহার বিচারের পূব্বেই আমি কিছু বলিতে চাই। মহাপ্রভুর নিজমন্ত্র আছে কিনা, এই কথার বিতর্ক কি জন্য উঠিল? যে আচার্য্যসন্তান এই বিতর্ক উঠাইলেন, তিনি কি সরলহহৃদয়ে এ বিষয়ের আন্দোলন করিলেন, অথবা পারমার্থিক বিষয় ব্যতীত অন্য কোন অভিপ্রায়দ্বারা উৎসাহিত হইয়াছেন। গৌড়ীয়বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ে কোন প্রকার দোষ না থাকে, এরূপ ইচ্ছাক্রমে কি এই বিতর্ক উদয় হইল? অনেক বিবেচনা করিয়া দেখিলাম যে তাহা নয়। কেননা যদি তাঁহার এরূপ ইচ্ছা থাকিত, তাহা হইলে তিনি অবশ্য যথার্থ দোষের সংশোধনের প্রয়াস করিতেন। হে ভক্তবৃন্দ। এই গৌড়ীয় সম্প্রদায়ে চারি শত বৎসরের মধ্যেঅনেক প্রকার অনর্থ উদয় হইয়াছে। সেই সকল অনর্থ সম্পূর্ণরূপে উৎপাটন করা আচার্য্যসন্তানদিগের প্রধান কার্য্য আচার্য্য-শব্দের অর্থ কি? যিনি স্বয়ং আচরণ করিয়া ধর্ম শিক্ষা দেন তিনিই আচার্য্য। কেবল বিতর্ক উৎপন্ন করিয়া সাংসারিক উন্নতি লাভ করিলে আচার্য্যত্ব লাভ হয় না। গৌড়ীয়সম্প্রদায়ের যাঁহারা আচার্য্যপদ লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের সম্প্রদায়ের অনর্থসকল দূর করিবার চেষ্টা করা উচিত। আমি দুই একটা অনর্থের উল্লেখ করিতেছি। আজ কাল গৌড়ীয়সম্প্রদায়স্থ বৈষ্ণবগণ চারি ভাগে বিভক্ত হইতে পারেন। যথাঃ-


১। পুজ্যপাদ মন্ত্রাচার্য্যগণ।

২। ভিক্ষাশ্রমগত অভ্যাগত বৈষ্ণবগণ।

৩। বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থাস্থিত প্রাপ্তভগবদ্দীক্ষ পুরুষগণ।

৪।' বৈষ্ণব জাতি' বলিয়া পরিচিত ব্যক্তিগণ।


এই চারিশ্রেণী বৈষ্ণবের মধ্যে যিনি ভক্তিসিদ্ধান্ত বিরোধী আচরণ করেন, তিনি সম্প্রদায়ের অনর্থের মূল। আমি কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বিদ্বেষপূর্ব্বক কিছুই বলিব না। অতএব যদি কাহারও আচরণের বিরুদ্ধ বাক্য হয় তিনি কৃপা করিয়া আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি উক্ত চতুর্ব্বিধ বৈষ্ণবগণের যে যে প্রধান অনর্থ আছে সহৃয়তার সহিত তাহার আলোচনা করিব।


পূজ্যপাদ মন্ত্রাচার্য্যগণ যথাশাস্ত্র সৎপাত্র থাকিয়া উপযুক্ত পাত্রকে মন্ত্রদান করিবেন। এতৎসম্বন্ধে পরস্পর-পরীক্ষা বিধি শ্রীহরিভক্তিবিলাসে উল্লিখিত হইলেও কার্য্যে প্রচলিত হয় না। তন্নিবন্ধন গুরুশিষ্যের উভয়েরই পতন ও তৎসঙ্গে সম্প্রদায়বিকার অনিবার্য্য হইয়া উঠিয়াছে। অধিকারবিচার যেখানে থাকে না, সেখানে সকলই বৃথা। হায়। শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর প্রচারিত পবিত্র বৈষ্ণবধর্ম কতদূর কলুষিত হইল।


ভিক্ষাশ্রমী বৈষ্ণবদিগের মধ্যেও অধিকার-বিচারভ্রষ্ট হওয়ায় অনেক প্রকার অনর্থ উপস্থিত হইয়াছে। ভিক্ষাশ্রমগমনের পূব্বেই সেই আশ্রমের অধিকার লাভ করা উচিত। আজকাল তাহা উঠিয়া গিয়াছে।


বর্ণাশ্রমস্থিত বৈষ্ণবদিগের ভক্তিতত্ত্ব চর্চার নিতান্ত অভাব হওয়ায় সদসৎ-বিবেচনাশূন্য হইয়া তাঁহারা যার তার সঙ্গ ও অযথা সম্মান করিয়া করিয়া নিজের চিত্ত কলুষিত করিতেছেন। চিত্ত শোধনপূর্ব্বক শুদ্ধ ভক্তি আশ্রয় করাই জীবের কর্তব্য; তাহা হইতেছে না। তাহাতে সাধুসঙ্গের অভাব হয়।


আজকাল মন্ত্রাচার্য্যদিগের অমনোযোগে বৈষ্ণবদিগের শুদ্ধভক্তিবিচার প্রায় রহিত হইতেছে। জাতি বৈষ্ণবগণ বিশুদ্ধভক্তিরহিত হইলেও বৈষ্ণব বলিয়া সম্মান পাইবার দাবী করিয়া থাকেন এবং সেই দাবী অবিবেচক বর্ণাশ্রমী বৈষ্ণবদ্বারা সম্মানিত হইতেছে।


আমি অদ্য অনর্থগুলির দিমাত্র দেখাইলাম আবশ্যক হইলে পৃথক্ পৃথক্ সকল কথাই বিচার করিব। এই সকল অনর্থ বিদূরিত করিবার জন্য উপরোক্ত চারিপ্রকার বৈষ্ণবের সম্মিলন পূর্ব্বক একটা সম্প্রদায়-দোষ-শোধনী সভা হওয়া আবশ্যক। আমি কৃতাঞ্জলি পূর্ব্বক নিবেদন করিতেছি যে, পূজ্যপাদ মন্ত্রাচার্য্যগণ এইরূপ একটা সভা সংস্থাপনপূর্ব্বক উক্ত অনর্থসকল যাহাতে শোধন হয় তাহার যত্ন করুন মন্ত্রাচার্য্যদিগের মধ্যে যাঁহাদিগের শ্রীগৌরাঙ্গে অনন্য-ভক্তি আছে, তাঁহারা তৎপ্রবর্তিত সম্প্রদায়কে নির্দোষ রাখিবার জন্য স্বভাবতঃ ব্যস্ত হইবেন, সন্দেহ নাই। দুঃখের বিষয় এই যে, যথার্থ সম্প্রদায়-দোষ দূরীকরণের যত্ন না করিয়া শ্রীমন্মহাপ্রভুসম্বন্ধে বৃথা বিতর্ক কেন উঠিয়াছে বুঝিতে পারি না। শ্রীমন্মহাপ্রভু স্বয়ং ভগবান নন্দনন্দন, একথার যখন কোন বিতর্ক নাই, তখন তৎসম্বন্ধে বৈধ-উপাসনা ও রাগমার্গীয় উপাসনার মধ্যে যে অনিবার্য্য পার্থক্য আছে, তঅবলম্বন পূর্ব্বক একটা বৃথা বিতর্ক উঠাইবার, কি আবশ্যকতা ছিল? অনুরাগিগণ বৈধ আচার্য্যদিগের মত লইয়া কাৰ্য্য কখনই করেন না ও করিবেন না। শ্রীকবিরাজ গোস্বামী কহিয়াছেন,-

"শাস্ত্রযুক্তি নাহি মানে রাগানুগার প্রকৃতি।" বৈধ ব্যবস্থাপক যদি রাগানুগার জন্য ব্যবস্থা করিতে যান, তাহা হইতে 'কামারের দই পাতা'র ন্যায় তাঁহার ব্যবস্থা কখনই ভাল হইবে না। কোন রাগানুগা ভক্ত বৈধভক্তদিগের অনুষ্ঠেয় কোন বিধির নিন্দা করিলে যেরূপ অবিচার হয়, অনুরাগীর সম্বন্ধে মন্ত্রাচার্য্যের বিধি নির্মাণ করাও সেইরূপ অনধিকার চর্চ্চা হইয়া উঠে। তাহাতে কেবল বিবাদ হয়, কোন ফল হয় না। আমি কৃতাঞ্জলিপূর্ব্বক জানাইতেছি যে, শ্রীমন্মহাপ্রভুর উপাসনাসম্বন্ধে বৈধ ও রাগানুগাদিগের যে পৃথক্ উপাসনা পদ্ধতি চলিয়া আসিতেছে, তাহা বিনষ্ট করিবার জন্য কেহ যেন চেষ্টা না করেন। এ সম্বন্ধে আমার আর কোন কথা না কহিতে হইলেই আমি বড় সুখী হই।

Comments


bottom of page