পুষ্টিমার্গ
- The Symbol of Faith
- Nov 26, 2024
- 3 min read

পুষ্টিমার্গ
— শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদ
স্থান— কলিকাতা ক্লাইভ-স্ট্রাটস্থ পুষ্টিমার্গীয় বৈষ্ণব-সভা, স্বধামগত রাজাবাবু দামোদর দাস বর্ম্মণের প্রাসাদ
সময়-১১ই চৈত্র, ১৩৩১ (২৫শে মার্চ্চ ১৯২৫)
(পুষ্টিমাগীয় বৈষ্ণব সঙ্ঘের বার্ষিক অধিবেশনোপলক্ষে)
পুষ্টিমার্গীয় ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবের মিলনের প্রাক্তন ইতিহাস
পুষ্টিমাগীয়-সভার সভাপতি মহোদয় ও সমাগত বৈষ্ণববৃন্দ! বড়ই আনন্দের সহিত প্রকাশ করিতেছি যে, শ্রীপুষ্টিমার্গীয় বৈষ্ণবসঙ্ঘ আমাদিগকে কিছু হরিকথা কীর্ত্তন করিবার জন্য আহ্বান করিয়াছেন। পুষ্টিমার্গীয় বৈষ্ণব ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবের সঙ্গে মিলন-বড়ই আনন্দের বিষয়, কিন্তু ইহা নূতন নয়। শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু যখন প্রয়াগধামে শুভ বিজয় করিয়াছিলেন, তখন শ্রীবল্লভাচার্য্য আড়াইল-গ্রামে বাস করিতেছিলেন। তিনি গৌরপার্ষদ শ্রীরূপের সহিত শ্রীমন্মহাপ্রভুকে নিজগৃহে লইয়া গিয়া সবংশে মহাপ্রভুর সমাদর করিয়াছিলেন (চৈঃ চঃ মধ্য।১৯শ।পঃ)। আজ আবার চারিশত বৎসর পরে, আপনারা এইসকল গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণকে পুষ্টিমার্গীয় বৈষ্ণবসঙ্ঘের গৃহে আহ্বান করিয়া লইয়া আসিয়াছেন। শ্রীবল্লভাচার্য্যের পুত্রদ্বয় গোপীনাথ ও বিঠ্ঠল-দেবও শ্রীরূপ-গোস্বামিপ্রভুর নিকট হরিকথাশ্রবণ করিয়াছিলেন। শ্রীলোকনাথ, শ্রীরঘুনাথ দাস, শ্রীরঘুনাথভট্ট, শ্রীজীব গোস্বামিগণও মথুরায় বিঠ্ঠল- গৃহে গোপাল বিগ্রহ দর্শন করিতে আসিতেন। শ্রীপুরুষোত্তমে শ্রীমন্মহাপ্রভুর সহিত শ্রীবল্লভাচার্য্যের সাক্ষাৎকার ও শ্রীবল্লভাচার্য্যের প্রতি শ্রীমন্মহাপ্রভুর উপদেশের কথা আমরা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে দেখিতে পাই।
বৈধ বা মর্য্যাদা-পথ ও রাগানুগ বা পুষ্টিমার্গ
গৌড়ীয়-বৈষ্ণবাচার্য্যবর্য্য শ্রীল রূপ-গোস্বামিপ্রভু শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে 'বৈধী' ও 'রাগানুগা'-নামে দুইপ্রকার সাধন-ভক্তির উল্লেখ করিয়াছেন। 'শাস্ত্রশাসনাদি বিধি-বিচার ভয়ে পূজার নাম— শ্রীবল্পভাচার্য্যের ভাষায়— 'মর্য্যাদামার্গ' অথবা গৌড়ীয়-বৈষ্ণবের ভাষায় 'বৈধমার্গ' এবং রাগাত্মিক ব্রজবাসি-জনের অনুগত হইয়া সেবাই 'রাগানুগা ভক্তি' শ্রীবল্লভাচার্য্যের 'পুষ্টিমার্গ'— উক্ত রাগানুগ-পথেরই একপ্রকার বিচার-প্রণালী। বৈধমার্গে শান্ত, দাস্য ও গৌরবসখ্যার্দ্ধ— এই অড়াই প্রকার রসের উল্লেখ আছে। অনুরাগ-পথ অবৈধ না হইলেও বিধিমার্গের ঐশ্বর্য্যরসের অন্তর্গত ব্যাপার নহে; উহা সেবারাজ্যের অত্যুচ্চতম শিখরে অবস্থিত। অধিকন্তু, তাহাতে বিশ্রম্ভসখ্য, বাৎসল্য ও মধুর-আরও আড়াই প্রকার রস-অধিক বর্ত্তমান। শ্রীরূপ-গোস্বামিপ্রভৃতিই বল্লভতনয় শ্রীবিঠ্ঠলনাথকে বালগোপাল ও কিশোরগোপালের সেবায় অধিকারী করেন। 'বল্লভদিগ্বিজয়' গ্রন্থে এ সকল কথা সুষ্ঠুভাবে বর্ণিত না হইলেও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে এসকল কথা বর্ণিত আছে।
শ্রীবল্লভাচার্য্যকর্ত্তৃক বৈষ্ণবজগতের উপকার
শ্রীবল্লভাচার্য্যজী মহারাজ বৈষ্ণবজগতের যে একটা বিশেষ উপকার সাধন করিয়াছেন, তজ্জন্য বিশ্ববাসী সকল বৈষ্ণবই তাঁহার নিকট ঋণী। তিনি মায়াবাদ-বিচারের যুক্তি সমূহ সম্যকরূপে খণ্ডন করিয়াছেন;— ব্রহ্মসূত্রের তৎকৃত 'অনুভাষ্যই' উহার সাক্ষ্যস্থল। নিত্য বিষ্ণুপাসনাপথের পরমবিরোধি-বিচারই— নির্ভিন্ন-ব্রহ্মবাদ। শ্রীবল্লভাচার্য্যের পরে শ্রীপুরুষোত্তমজী মহারাজ 'অনুভাষ্যে'র টীকায় বল্লভাচার্য্যের মায়াবাদ- খণ্ডনসিদ্ধান্ত আরও সুষ্ঠুরূপে প্রচার করিয়াছেন। 'বাদাবলী'-নামক সংগ্রহগ্রন্থে উল্লিখিত আছে যে, শ্রীপুরুষোত্তমজী মহারাজ স্বনাম প্রসিদ্ধ অপ্যয়-দীক্ষিত-নামক মায়াবাদী বৈদান্তিক মহাপণ্ডিতকে ভগবদুপাসনায় নিযুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। শ্রীবল্লভাচার্য্যের অধস্তন সম্প্রদায়ের অনেকেই মায়াবাদ-নিরসনের জন্য যত্ন করিয়াছেন।
রাগমার্গের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মহিমা
যাঁহারা ক্ষুদ্রবিচারে আবদ্ধ, তাঁহারা পুষ্টিমার্গের সৌন্দর্য্য ও মাধুর্য্য উপলব্ধি করিতে পারিবেন না। ভগবানের সহিত সমতা বা তাঁহা অপেক্ষাও অধিক সামর্থ্যযুক্ত না হইলে প্রেমসেবা হয় না। বিশ্রম্ভসখ্যরসের রসিকগণ কৃষ্ণকে উচ্ছিষ্ট ফল ভক্ষণ করাইতে পারেন- কৃষ্ণের ঘাড়ে চড়িতে পারেন; বৎসলরসের রসিক যশোদা পুত্রজ্ঞানে ও পাল্যবিচারে কৃষ্ণকে বন্ধন ও প্রহারাদি পর্য্যন্ত করিতে পারেন; এবং মধুর-রসের রসিক শ্রীবৃষভানুনন্দিনী প্রমুখা গোপীগণ সর্ব্বতোভাবে কৃষ্ণকে সেবা করিতে পারেন, আশ্রয় হইয়াও বিষয়ের দ্বারা আনুগত্য করাইতে পারেন। এই সকল কথা প্রাকৃত-বিচার বা অক্ষজজ্ঞান প্রবল থাকিতে কেহই বুঝিতে পারিবেন না; অথবা কেহ বুঝিবার চেষ্টা করিলেও অনর্থ উৎপন্ন হইবে মাত্র।
শ্রীরামানুজ, শ্রীমধ্ব ও শ্রীনিম্বার্কের বিচার
শ্রীলক্ষ্মণদেশিকাচার্য্যের বিচারে কেবলমাত্র বৈকুণ্ঠের শান্ত ও দাস্য- রসের কথা পাই। কিন্তু প্রীতিবন্ধিত বিশ্রম্ভসখ্যাদির কথার নিকট ঐশ্বর্য্য-মার্গের কথা যে নিতান্ত বাল-ভাষিত, তাহা রাগানুগ-সম্প্রদায়ের বিচারের দ্বারাই বুঝিতে পারিবেন। পূর্ব্বকালে ভারতবর্ষে যে নাস্তিক্যবাদ বিভিন্ন নাম ধারণ করিয়া বৌদ্ধমত, জৈনমত ও নির্বিশেষ মায়াবাদ-নামে প্রচারিত হইয়াছিল, তাহার নিরাকরণকল্পে শ্রীরামানুজাচার্য্য দাস্যভাবে ভগবানের যে নিত্য উপাসনার কথা জগতে প্রচার করিয়াছেন, তজ্জন্য সমগ্র বৈষ্ণবজগৎই তাঁহার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিবেন। কিন্তু রাগানুগভজনই সর্ব্বোচ্চ পরবর্তিকালে শ্রীমধ্বমুনি ও শ্রীনিম্বার্কাদি আচার্য্যগণও এইবিষয়ে সুষ্ঠু ও সুষ্ঠুতরভাবে কথঞ্চিৎ আলোচনা করিয়াছেন।
শ্রীগৌড়ীয় ও শ্রীবল্লভানুগ গণের মিলনাকাঙ্ক্ষা
শ্রীল রূপগোস্বামিপাদের সহিত গোপীনাথ ও বিঠ্ঠলের যেরূপ মিলন হইয়াছিল, শ্রীমন্মহাপ্রভুর সহিত শ্রীবল্লভাচার্য্যের যেরূপ সম্মেলন হইয়াছিল, শ্রীগৌড়ীয়গণ ও বল্লভানুগ গণও যদি সেইরূপ প্রেমনয়নে পরস্পর মিলিত হইতে পারেন, তাহা হইলে উভয়েই এক সেব্যবিগ্রহ শ্রীরাধা-গোবিন্দের প্রেমসেবা করিয়া জীবন ধন্য করিতে পারিবেন, পরস্পরের সাপত্ন্যভাব আর থাকিবে না।
(শ্রীল প্রভুপাদের বক্তৃতাবলী, প্রথম খণ্ড হইতে সংগৃহীত)
Comments