top of page
Search

গৌড়ীয়ের বেষ

  • Writer: The Symbol of Faith
    The Symbol of Faith
  • Jan 20
  • 4 min read

— জগদগুরু ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদ


তারিখ : ১৯ জানুয়ারী ২০২৫


এক ব্যক্তি গৌড়ীয় বৈষ্ণবের বেশ কি, তাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। 'গৌড়ীয় বৈষ্ণব' কথায় দুইটী শব্দ আছে, তন্মধ্যে আদি শব্দ 'গৌড়ীয়ে' সাধারণতঃ গৌড়দেশবাসীকে বুঝায়। ভারতের উত্তরে, হিমালয়ের দক্ষিণে, বিন্ধ্যগিরির উত্তরভাগে দেশকে 'আর্য্যাবর্ত্ত’ বলে। সেই আর্য্যাবর্ত্তকে প্রাদেশিক নাম হইতে অপর ভাষায় পঞ্চ গৌড় বলে। বিন্ধ্যের দক্ষিণাংশে ভারতবর্ষের ভূমিগুলি পঞ্চদ্রাবিড় দেশ বলিয়া প্রসিদ্ধ। পঞ্চগৌড় দেশের অধিবাসিগণ সকলেই আৰ্য্যাবর্ত্তবাসী বা গৌড়ীয়। মনু বলেন, পূর্ব্ব সমুদ্র হইতে পশ্চিম সমুদ্র পর্য্যন্ত ভূভাগ আৰ্য্যাবর্ত্ত। গৌড়দেশ বলিতে সাধারণতঃ কান্যকুজ, সারস্বত, মধ্যগৌড়, মৈথিল ও উৎকল দেশকে বুঝায়। আর্য্যাবর্ত্তের পূর্ব্বাংশকে কিছুদিন হইতে গৌড়দেশ বলিয়া সংজ্ঞা প্রদত্ত হয়। 'শ্রীচৈতন্য- চরিতামৃত' নামক গৌড়ীয় ভাষার গ্রন্থে শ্রীনবদ্বীপ নগরকেই গৌড়ের প্রধান স্থান বলিয়া উল্লিখিত হয়; যদিও কেহ কেহ মালদহ, কান্সুনিয়া প্রভৃতি স্থানকে গৌড় আখ্যা দিতে প্রস্তুত আছেন, তথাপি নবদ্বীপনগরে গৌড়দেশের কেন্দ্রভূমি বলিয়া আদিম বঙ্গীয় সাহিত্যে উল্লিখিত আছে। শ্রীনবদ্বীপনগরের শ্রীমায়াপুর পল্লীতে সেনবংশীয়গণের সাম্রাজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই শ্রীধাম মায়াপুরেই মৌলানা সিরাজুদ্দিনের গৃহ অর্থাৎ চাঁদ কাজীর বাড়ী ছিল। এই জন্য গৌড়দেশের রাজধানীসূত্রে নবদ্বীপনগরে আবির্ভূত শ্রীগৌরসুন্দরকে গৌড়দেশবাসিগণ তাঁহাদের একমাত্র উপাস্য বলিয়া জানেন। যাঁহারা আর্য্যাবর্ত্তের অধিবাসী না হইয়াও শ্রীমন্মহাপ্রভুর শ্রীচরণাশ্রিত, তাঁহারাও আপনাদিগকে গৌড়ীয় বলিয়া পরিচয় দেন। শ্রীগৌরসুন্দর তাঁহার অনুগত দাস শ্রীদামোদর স্বরূপকে গৌড়ীয়গণের মালিক বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। 'গৌড়ীয়' শব্দে সাধারণতঃ শ্রীগৌরহরির আশ্রিত জনগণকেই বুঝায়। এজন্য গৌড়ীয়ের যোগরূঢ় অর্থে গৌড়ীয়-বৈষ্ণবকেই লক্ষ্য করে। 'পঙ্কজ' বলিলে যেরূপ পদ্মকেই বুঝায়, তদ্রূপ।


জীবমাত্রেই স্বরূপতঃ কৃষ্ণদাস বা বৈষ্ণব। বৈষ্ণবের একমাত্র কৃত্য হরিসেবা। যে-সকল বৈষ্ণব স্বরূপে অবস্থিত হইয়া হরিসেবা করেন, তাঁহাদিগকেই বৈষ্ণব বলা হয়, অন্যান্য জীব বৈষ্ণব হইলেও স্বরূপবিস্মৃত বলিয়া তাঁহাদিগের অবৈষ্ণব সংজ্ঞা। পৃথিবীর যাবতীয় জীব বৈষ্ণব। ভারত পৃথিবীর অন্তর্গত, সেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পারমার্থিকের সহিত গৌড়দেশীয় পারমার্থিকের বিশেষত্ব নির্দ্ধারণে গৌড়ীয় বৈষ্ণবের সংজ্ঞায় গৌরপদাশ্রিত জনকেই বুঝায়। যে-সকল বৈষ্ণব ভগবৎসেবাবর্জ্জিত হইয়া অপর সংজ্ঞায় পরিচিত, অথবা বৈষ্ণব বলিয়া আপনাকে জানেন না, তাঁহারাই অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বলিয়া আপনাদিগকে অবৈষ্ণব সংজ্ঞা দেন। শ্রীহরিভক্তিবিলাস বলেন,-


"গৃহীতবিষ্ণুদীক্ষাকো বিষ্ণুপূজাপরো নরঃ। বৈষ্ণবোহভিহিতোহভিজ্ঞৈরিতরোহম্মাদবৈষ্ণবঃ॥"


যেরূপ শৌক্রবিধানদ্বারা সাবিত্র্য সংস্কারের কথা কতিপয় কল্পশাস্ত্রে উল্লিখিত আছে, এবং সেই কল্পশাস্ত্রের বিধানমত সংস্কারাদিসম্পন্ন ব্যক্তি সংজ্ঞা লাভ করেন, সেইরূপ দীক্ষাবিধান দ্বারা অবৈধবিধানে শূদ্রতা ও বৈধবিধানে দ্বিজত্বরূপ বর্ণদ্বয় সিদ্ধ হয়। "তথা দীক্ষা-বিধানেন দ্বিজত্বং জায়তে নৃণাং।” কর্ম্মকাণ্ড-প্রসক্ত বেদশাখিগণ শৌক্রপন্থার অবলম্বনে যেরূপভাবে বর্ণ নির্ণয় করেন, তাহা অধিকতর সমীচীন। ভারতবর্ষে বৃত্তগত পরিচয় হইতে অসংখ্য ঋষি উদ্ভূত হইয়াছেন। সেই ঋষিগণের শৌক্র অধস্তনগণই শৌক্রপদ্ধতিতে পরিচিত বর্ণ। মহাভারত ও ভারতীয় ঐতিহ্য-পুরাণাদি বৃত্তগত বর্ণ-নির্ণয়ের কথা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছেন। তাদৃশ বৃত্তোৎপন্ন বর্ণবিচার শৌক্র পদ্ধতির মূলে অবস্থিত। শৌক্র সাবিত্র্য পদ্ধতিমতে প্রস্তাবিত বর্ণ অনেক সময় পরিবর্তিত হইয়াছে। যেখানে মৌলিক সনাতন ধর্ম্ম বিকৃত হইয়া ধৰ্ম্মাভাসে পরিণত, সেখানে তাৎপর্য্যহীন অনভিজ্ঞতা পরিস্ফুট। সাধারণ ব্যক্তির সংখ্যা মহাজনের সংখ্যা অপেক্ষা অনেক বেশী। জনসঙ্ঘের অনভিজ্ঞতাজাত ধারণা অনেক সময় বিচার অতিক্রম করে। তাই বলিয়া সত্য চিরদিন আবৃত থাকিবে, এরূপ নয়। কুজ্ঝটিকায় সূর্য্যকিরণ অথবা মেঘের দ্বারা ভাস্করকে আবৃত দেখিলেও বা ভাস্করের কিরণ বাধাপ্রাপ্ত বোধ হইলেও সত্যই উহা বিলুপ্ত হয়না, সেইরূপ সত্যের মর্য্যাদা কলিযুগে অনেকটা ক্ষীণ হইলেও সত্য জগৎ হইতে একেবারে তিরোহিত হয় নাই। দুঃখের পর সুখ, সুখের পর দুঃখ—সুখ-দুঃখের পরিমাণগত ভেদমাত্র। বর্ণের উচ্চাবচ ভাব গুণকর্ম্মের পরিমাণের উপর নির্দ্দিষ্ট হয়।


দৃশ্য জগতে বা কর্ম্মভূমি ভারতে গুণকৰ্ম্মভেদে যে উচ্চাবচ বর্ণ নির্ণীত হইয়াছে, তাহা গুণ ও কর্ম্মের পরিমাণানুসারে সিদ্ধ হয়। পরমার্থহীন নিরীশ্বর জগৎ গুণ ও কর্ম্মানুসারে বর্ণ নিরূপণ করেন। সেশ্বর নীতিপরায়ণ সমাজ গুণ ও কৰ্ম্ম অনুসারে বর্ণনিরূপণের পক্ষপাতী। বিষ্ণুভক্তিরহিত কর্ম্মকাণ্ডীয় বিচারে ঐকান্তিক বিষ্ণুভক্তির অভাব আছে। হংসজাতির সহিত ভেদবাদী বিষ্ণুবিদ্বেষী জনগণ যে অবৈষ্ণব-সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন, তাহাতে বর্ণবিভাগ আছে। বিষ্ণুর সংজ্ঞান্তর 'ব্রহ্ম' শব্দের বিচার অবলম্বনপূর্ব্বক ব্রহ্মজ্ঞগণ আপনাদিগের ব্রাহ্মণত্ব স্থাপন করেন। যোগিগণ বৈষ্ণব-বিচারের প্রতিপক্ষে জীবাত্মা ও পরমাত্মার সান্নিধ্যপ্রয়াসী হইয়া আপনাদিগকে ভক্তিহীন যোগী বলিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন। ভগবদ্ভক্তগণ তাঁহাদের সহিত বিরোধ না করিয়া তাঁহাদিগকেও প্রাকৃত বিচারযুক্ত মিছা-বৈষ্ণবগণের সহিত সমজ্ঞান করেন। যে কালে বৈষ্ণবের সহিত অবৈষ্ণব ব্রাহ্মণের বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল, তাৎকালিক ভারতীয় সাহিত্য আলোচনা করিলে আমরা জানিতে পারি যে, অবৈষ্ণব ব্রাহ্মণগণ বৈষ্ণবগণের সহিত আপনাদিগের পার্থক্যস্থাপন মানসে স্ব-স্ব ভক্তিবিরোধী কর্ম্মকাণ্ড প্রচার করিয়াছিলেন। শ্রীরামানুজের পরমগুরু শ্রীআলবন্দারু ঋষি ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে এই অবৈষ্ণব ব্রাহ্মণগণের কুবিচার-প্রণালী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, আবার পণ্ডিতবর অপ্পয়দীক্ষিত প্রভৃতি অবৈষ্ণব ভট্টগণ যামুনাচার্য্যের প্রতিকূলে নানা কথার প্রজল্পনা করিয়াছেন। যাঁহারা বর্ণবিধান সুষ্ঠুভাবে আলোচনা করিতে অভিলাষ করেন, তাঁহারা শ্রীমদ্ভাগবত পঞ্চমস্কন্ধ, একাদশ স্কন্ধ, নারদপঞ্চরাত্র, সাত্বত-সংহিতাসমূহ, 'আগমপ্রামাণ্য,' সংস্কার- চন্দ্রিকা, সংস্কারদীপিকা, বৃদ্ধমনু প্রভৃতি আকর ও আকরানুগ গ্রন্থসমূহ পাঠ করিলে তাহাদিগের সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা বিদূরিত হইয়া দৈক্ষ্য-সাবিত্র্য- বর্ণাবধানের যাথাত্ম্য উপলব্ধি ঘটিবে। যাঁহারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বেদান্ত ভাষ্য আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহারাও জানিতে পারিবেন যে, ভারতবর্ষে মধ্যযুগে নানা প্রকারে বৃত্ত-ব্রাহ্মণতার প্রবল প্রচার হইয়াছিল। বর্ত্তমান শৌক্র-বর্ণবিধান তাদৃশ অনুষ্ঠানের পরিণতি কিনা, তৎপ্রতিকূলে কি কি প্রমাণ আমরা দেখাইতে পারি?


শ্রীমদ্ভাগবত বলেন, "সর্ব্বেষাং মদুপাসনম্” অর্থাৎ যে কোনও বর্ণে পরিচিত ব্যক্তি ভগবদুপাসনা করিতে পারিবেন। মহারাজ অম্বরীষ বাহিরে ক্ষত্রধৰ্ম্মে অধিষ্ঠিত বলিয়া প্রচারিত থাকিলেও, দুর্ব্বাসার ন্যায় ঋষি তাঁহার ব্রাহ্মণত্বে সন্দিহান হইবার ফলস্বরূপ যে বিপদাক্রান্ত হইয়াছিলেন, তাহা ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খচিত আছে। বাহ্যজগতে অক্ষজজ্ঞানবাদীর জন্য বর্ণচিহ্ন ও আশ্রম চিহ্নের ব্যবস্থা নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় নহে। তবে অক্ষজজ্ঞানবাদী চিহ্নমাত্র দেখিয়াই অনেক সময়ে প্রতারিত হন। প্রতারিত হইবার ফলে সিঁদুর মেঘ দেখিলেই যেরূপ গবাদি পশু ভীত হয়, সেইরূপ- ভাবে বৈষ্ণবের বাহ্য চিহ্ন লইয়াই ব্যতিব্যস্ত হন। অন্তরানুধাবন-প্রবৃত্তির অভাবে এরূপ বিড়ম্বনা অবশ্যম্ভাবী।


গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরমহংস হইতে পারেন, তখন তাঁহার বেষ দেখিয়া কেহ বৈষ্ণব বা অবৈষ্ণব স্থির করিতে পারেন না। শ্রীসনাতন গোস্বামীর বেষে বর্ণাশ্রমের চিহ্ন নাই, আবার শ্রীপ্রবোধানন্দ সরস্বতী গোস্বামীর বেষে পরিধানে কাষায় বস্ত্র ও ত্রিদণ্ড দেখা যায়। শ্রীপরমানন্দ পুরী, ঈশ্বরপুরী প্রভৃতির বেষে একদণ্ড ও কাষায় বস্ত্র। ত্রিদণ্ডী ও একদণ্ডী বা নির্দণ্ড সকলেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব হইতে পারেন। তাঁহারা কর্ম্ম-ত্রিদণ্ড, জ্ঞান-ত্রিদণ্ড এবং ভক্তি নির্দণ্ড প্রভৃতি আশ্রমচিহ্ন পরিত্যাগ করিবার বেষ লইতে পারেন। আবার বর্ণাশ্রমে অবস্থিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবের অভাব নাই। তাঁহাদের বর্ণচিহ্ন, আশ্রমবেষ রাখিয়াও তাঁহারা গৌড়ীয় বৈষ্ণব হইতে পারেন, আবার তত্তচ্চিহ্ন ধারণ করিয়া বর্ণাশ্রমে অবস্থিত হইবারও কেহ বাধা দিতে পারেন না। কাষায় বসন-মাহাত্ম্য, ত্রিদণ্ড-মাহাত্ম্য প্রভৃতি শাস্ত্রে প্রচুর পরিমাণে উল্লিখিত আছে। চিহ্নদ্বারা বা বেষগ্রহণ রীতি দর্শনে গৌড়ীয় বৈষ্ণব নির্দ্দিষ্ট হয় না। হরিন্ডজনে নিষ্কপটতাই বৈষ্ণব-পরিচয়ের একমাত্র নিদর্শন। যাঁহারা কর্ম্মকাণ্ড বৈষ্ণবের স্কন্ধে চাপাইতে গিয়া বৈষ্ণবকে কর্ম্মী বা জ্ঞানী মাত্র জানেন, তাঁহারা সুবিচার করিতে অসমর্থ ও বৈষ্ণবাপরাধী। কৌপীন-বহির্ব্বাসাদি দেখাইয়া যাঁহারা বৈষ্ণবতাকে বিপন্ন করেন এবং ভজনের সন্ধান না রাখিয়া 'নবমীতে আলাবু ভক্ষণ (লাউ ভক্ষণ) নিষেধ' প্রভৃতি বিধিই বৈষ্ণবাচার বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে ব্যস্ত তাঁহারা শ্রীমদ্ভাগবতের বিচারমতে ত্রিধাতুক কুণপ লইয়াই প্রমত্ত; সুতরাং বৈষ্ণব-বেষ স্থির করিতে গিয়া লোকদৃষ্টির অনুগমনে বৈষ্ণব চিনিতে অসমর্থ।

 
 
 

Comentários


পরম্ বিজয়তে শ্রী কৃষ্ণ সংকীর্ত্তনম্

  • Instagram
  • Facebook
  • Youtube
  • Whatsapp
  • Telegram
  • Dribbble
  • TikTok

@২০২৪ চেতনার জাগরণ - এর দ্বারা

bottom of page