কলিকাতায় কীর্ত্তন
কলিকাতায় কীর্ত্তন
— ঠাকুর শ্রীশ্রীল ভক্তিবিনোদ
বিগত ১৪ই চৈত্র (১৩০৫ বঙ্গাব্দ) হইতে কলিকাতার পল্লীতে পল্লীতে মহা সমারোহে নাম-সংকীর্ত্তন হইতেছে। "শ্রীগৌরাঙ্গ-সমাজের” নেতৃপক্ষদিগের মনে একটা ভাব উঠিল, সেই ভাবদ্বারা চালিত হইয়া নগরবাসীদিগের সাহায্যে বিডনষ্ট্রীটে শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর জন্মদিনে প্রথম সংকীর্ত্তন হয়। অনেকানেক বৃদ্ধলোকের মতে ঐরূপ সংকীর্ত্তন-মহোৎসব কলিকাতা মহানগরীতে আর কখনও হয় নাই। সে-দিবসে শ্রীগৌরাঙ্গদেবের এরূপ কৃপা দেখা যায় যে, অনেক ব্যয়কুণ্ঠ লোকেরাও মিষ্টান্ন সেবা দিয়া কীর্ত্তনকারীদিগকে সন্তুষ্ট করিয়াছিলেন। কি পাষণ্ড, কি ভগবদ্ভক্ত, সকলেই এক মনে শ্রীনাম-সংকীর্ত্তনে যোগ দিয়াছিলেন। শ্রীমহাপ্রভুর জন্মদিনে এইরূপ সমারোহে সর্ব্বদেশে নাম-সংকীর্ত্তন হওয়া আবশ্যক।
এই মহোৎসব হইতে নগরবাসীগণ কীর্ত্তনপ্রিয় হইয়া উঠিলেন। এমন কি, অন্য সকল কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া বহুব্যয়পূর্ব্বক প্রত্যেক পল্লীতে একটা একটা কীর্ত্তনদল স্থাপিত হইল। এ সমস্তই মহাপ্রভুর ভঙ্গী। জীবের পক্ষে হরিনাম ব্যতীত আর গতি নাই— বিশেষতঃ কলিযুগে। এটা বড় সুখের বিষয় যে, ভারতের সর্ব্বপ্রদেশস্থ লোকেরা কলিকাতায় থাকিয়া শ্রীনাম-কীর্ত্তনে যোগ দিয়াছেন। বিশেষতঃ পশ্চিমের লোকেরা, যাঁহারা কখনও মহাপ্রভুর নাম শুনেন নাই, তাঁহারাও শ্রীহরিনাম-কীর্ত্তনে যোগ দিয়া নিত্যানন্দ-গৌরাঙ্গ নামে উন্মত্ত হইয়াছেন। বড়বাজারের বহুতর দোকানদার ও দালাল প্রভৃতি পশ্চিম-নিবাসিগণ বহু যত্নে ও বহু অর্থব্যয়ের দ্বারা নগর-কীর্ত্তনের অনুষ্ঠান করিয়াছেন। কলিকাতার প্রত্যেক পল্লীর নিবাসিগণ আপন আপন পল্লীতে মহা সমারোহে কীর্তন করিয়াছেন। যদিও জিগীষাক্রমে অনেক কার্য্য হইতেছে, তথাপি শ্রীনাম কীর্ত্তন কিছুই দোষের জন্য হয় না।
আমরা শ্রীগৌরাঙ্গ-প্রভুর জন্মদিবসে কীর্ত্তনের জন্মভূমি মহাপ্রভুর জন্মস্থান শ্রীনবদ্বীপ মায়াপুরে জন্ম-মহোৎসবে নিযুক্ত ছিলাম। কয়েকদিন পরে আমরা কলিকাতায় আসিয়া কীর্ত্তন-স্রোত লক্ষ্য করত বড় সুখ লাভ করিলাম। কয়েকটী কীর্ত্তন দেখিয়া আমাদের মনে এইপ্রকার ভাব হইল। সকলই প্রভুর লীলা। প্রভু যখন যাহা করেন, তখনই তাহা হয়। জীবের কিছুই ক্ষমতা নাই। যে কলিকাতায় ধৰ্ম্ম একেবারে উঠিয়া যাইতেছিল সেই কলিকাতায় প্রভুর শক্তিক্রমে সর্ব্বধর্ম্মের সার ধর্ম যে হরি-কীর্ত্তন, তাহাই প্রবল হইয়াছে; কিন্তু মহাপ্রভু এইসকল কার্য্যে উৎসাহ দিয়াও তাঁহার অতি গুপ্ত-রহস্য যে প্রেম, তাহা এই মহানগরীতে বিতরণ করেন নাই। যথেষ্ট উৎসাহ দিয়াছেন ও তাঁহার আপনাকে প্রচার করিবার জন্য সর্ব্বপ্রকার লোককে মতি দিয়াছেন; এমন কি, অন্যান্য সুখ পরিত্যাগেরও শক্তি দিয়াছেন, কিন্তু বিশুদ্ধ প্রেমভক্তির দ্বার উদ্ঘাটন করেন নাই। কীর্ত্তনকারীদিগের হৃদয়ে কীর্ত্তন-স্পৃহা দিয়াছেন, কিন্তু পূর্ব্ব-মহাজনদিগের পথে অনুগত হইবার জন্য প্রবৃত্তি আজও দেন নাই।
চৰ্ম্ম-পাদুকা ছাড়িয়া অনেকে খোল-করতালের সহিত কীর্ত্তন করিতেছেন, তথাপি অনেকের গলায় তুলসীর মালা দেখিলাম না। যদিও কেহ কেহ ধারণ করিয়াছেন, সে-মালাগুলিও নূতন। তাহাতে অনেক সন্দেহ হয়। অনেকের অঙ্গে দ্বাদশ তিলক শোভা করিতেছে না। আজ নিমতলার ঘাটে, কল্য যোড়াসাঁকোয়, আবার একদিন ঝামাপুকুরে মহাজনী-প্রণালীতে কীর্ত্তন শ্রবণ করিবার জন্য গিয়া দেখি, কোথাও সেইরূপ পাইলাম না। ন্যাড়া, বাউল, যাত্রা, থিয়েটার— এই সকল সুরে রঙ্গের গান শুনিলাম; তাহাতে আমাদের যে-পরিমাণ দুঃখ হইল, তাহা মধ্যে মধ্যে হরি, কৃষ্ণ, রাম— এইসকল নিত্য নাম শ্রবণ করিয়া কথঞ্চিৎ দূর হইল। যাঁহাদের হৃদয়ে প্রেমভক্তি আছে, তাঁহারা প্রায়ই প্রাচীন নামের সুর ভালবাসেন। তাঁহারা বাজে কথা গান করিতে বা শুনিতে চান্ না। তাঁহারা প্রাচীন-ভাবে শুদ্ধ হরিনাম গান করেন ও শ্রবণ করেন।
এই মহানগরীর পল্লীবাসিগণ আজকাল সৎসঙ্গাভাবে শুদ্ধভক্তির স্বভাব সহজে লাভ করেন না। কাযে কাযেই তাঁহারা স্বকপোল-কল্পিত পদ্ধতি অবলম্বন করেন। ইহাও প্রভুর লীলা। প্রভুর যা ইচ্ছা তাহাই হউক, আমাদের ইহাতে কোন কথা নাই। খোল-করতালাদি প্রাচীন যন্ত্র ব্যতীত আধুনিক ও বৈদেশিক যন্ত্রসকল কীর্ত্তনে প্রবেশ করাইলে অনেক রঙ্গ হয় বটে, কিন্তু শ্রীভক্তিদেবীর ক্রমভঙ্গ হইয়া পড়ে। আজ-কাল আমরা বৈদেশিক ব্যবহারে এত মুগ্ধ যে, ভজন-প্রণালীর মধ্যে তাহাকে প্রবেশ করাইতে যত্ন করিয়া থাকি।
যাহাই হউক, আমাদের শ্রীগৌরাঙ্গ প্রভু বড়ই দয়ালু। তিনি যখন কলিকাতা মহানগরীর উপর একটু দৃষ্টিপাত করিয়া কীর্ত্তনে মতি দিয়াছেন, তখন আমরা ভরসা করি যে, এই মহানগরবাসিগণের হৃদয়ে ক্রমে ক্রমে শুদ্ধা ভক্তির সঞ্চার করিবেন।
কতকগুলি লোকে বলেন যে, নগরবাসিগণ প্লেগের আগমনে এই সকল কীর্ত্তন-প্রথা সৃষ্টি করিয়াছেন। যদি তাহাও হয়, তাহাতেও আমাদের কোন দুঃখ নাই, কেননা বিধি-বাক্য এই—
"অকামঃ সর্ব্বকামো বা মোক্ষকাম উদারধীঃ।
তীব্রেণ ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম্ ॥”
অর্থাৎ যিনি উদার-বুদ্ধি পুরুষ তিনি অকামী হউন, সর্ব্বকামী হউন, অথবা মোক্ষকামী হউন, তীব্র ভক্তিযোগে পরম-পুরুষকে যজন করিবেন। কৃষ্ণই পরম পুরুষ। কৃষ্ণনাম সংকীর্ত্তনই কলিকালের মহাযজ্ঞ। যিনি সুবুদ্ধিমান, তিনি সর্ব্বকাম হইয়াও সেই কৃষ্ণকে সংকীর্ত্তন যজ্ঞে যজন করিবেন। প্লেগ নাশ করিবার কামনায় অন্য সকল উপায় দূর করিয়া তীব্র ভক্তিযোগদ্বারা কৃষ্ণ-সংকীর্ত্তনরূপ মহাযজ্ঞ সম্পাদন করিবেন। বোম্বাই প্রদেশের লোকেরা যদি কলিকাতা-নিবাসিদিগের অনুকরণ করিতেন, তবে তাঁহারাও অবিলম্বে প্লেগমুক্ত হইতেন, সন্দেহ নাই। নগরবাসিগণ প্লেগ নিবারণের জন্য সংকীর্ত্তন করিলেও দোষী হইতে পারেন না। যে- সকল লোকেরা কীর্তন-বিরোধী, তাহারা দেশের যে পরম শত্রু, ইহাতে আর সন্দেহ নাই।
আমাদের আর একটা কথা আছে। সংকীর্ত্তন হউক, কিন্তু পর্ব্বদিন অবলম্বন করা আবশ্যক। দর্শ পৌর্ণমাসী, একাদশী, গৌর পৌর্ণমাসী, কৃষ্ণাষ্টমী, কার্ত্তিক মাস, বৈশাখ মাস, ভগবানের যাত্রাসকল, সংক্রান্তি,— এই সকল পর্ব্বদিন অবলম্বন করিয়া হরি-কীর্ত্তন হইলে ভাল হয়। প্রাচীন মহাজনী সুরে খোল-করতাল ইত্যাদি প্রাচীন যন্ত্র লইয়া নিজে নিজে পবিত্র বৈষ্ণবভাবে শ্রীনাম-কীর্ত্তন করিয়া নগরবাসিগণ আমাদিগের হৃদয়ে পরমানন্দ দান করুন। তাঁহাদের কীর্ত্তন-মহোৎসবে আমরা সুখী হইয়াছি, আগর যথানিয়নে হরিসংকীর্ত্তন করিয়া আমাদিগকে পরম সুখী করুন। শ্রীগৌরাঙ্গ জগদ্গুরু; তাঁহাদিগকে ইচ্ছামত ফল অবশ্য প্রদান করিবেন।
—জগদ্গুরু শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর
Yorumlar