top of page

আবার কেন?

আবার কেন?


( ২রা ভাদ্র ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, ইং ১৯ই আগষ্ট ১৯২২ খৃষ্টাব্দ, শনিবারের “গৌড়ীয়” ১ম বর্ষের ১সংখ্যায় শ্রীগৌড়ীয় মঠ হইতে পুর্ব্ব প্রকাশিত।)


সাপ্তাহিক সাময়িক পত্র গৌড়ীয়। বাঙ্গলা দেশে হাজারের উপর কাগজ থাকতে “গৌড়ীয়” আবার কেন এ প্রশ্ন সকলের মনেই উঠিতে পারে। গৌড়ীয়ের সহিত অপর সাময়িক পত্রগুলির বিশেষত্ব কি? জবাবে অনেক কথা তবে কাগজের মুখপাতেই আমরা দেখিতেছি ইহাতে পরমার্থের সমালোচনা আছে। তাহার সঙ্গে সঙ্গেই ধৰ্ম্ম, অর্থ কাম, মোক্ষ এই চতুর্ব্বর্গের কথা এবং সমাজ, নীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, প্রত্নতত্ত্ব, সাহিত্য, কাব্য প্রভৃতি নানারকম দশের কথা আলোচনারও ইহাতে অভাব নাই। অন্যান্য অনেক কাগজের ন্যায় সংসারের নানাপ্রকার পণ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপনও ইহাতে স্থান পাইয়াছে। মোটের উপর গৌড়ীয়ের বিভিন্ন পাঠকগণ কোন সম্প্রদায় বিশেষ নহেন বরং সকল শ্রেণীর পাঠোপযোগী নানাকথাই ইহাতে স্থান পাইতেছে। এখন জিজ্ঞাস্য এই যে জগতের রুচি যখন নানাপ্রকার তখন গৌড়ীয়ের কাহারও মনোরঞ্জন করিতে গিয়া অবশিষ্ট বিপরীত রুচির লোকদিগের শত্রু হবার দরকার কি? এই সকল কথা গৌড়ীয় পরিচয়ে আলোচনা না করে চুপ্ করে ঘরে বসে নিজে নিজে ধ্যান করলেই তো ভাল ছিল। এখন কথা হচ্ছে যে কি ধ্যান করলে কোন গণ্ডগোল হবে না তাহা না জানতে পারলে গণ্ডগোলই ধ্যান হয়ে যাবে যে। সে জন্যই ধ্যানের জিনিস্টা কি হবে তার জন্য

একটু মাথা ব্যথা হচ্ছে। আর ধ্যানটাই বা কারা কর্ব্বে? ধ্যান করতে গিয়ে ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যাবে না তো? বাহিরের বিরোধ থামাতে গিয়ে ধ্যানের পরামর্শটা নিতে গেলুম্ তাতেও তো দেখছি বিষম গোল। কেউ বল্লেন নিরাকার ধ্যানটাই ভাল, কেউ বলছেন সাকার জড় নইলে ধ্যান কিরূপে হবে? তবেই পরমার্থ বিষয়টা আমরা ছেড়ে দেবো মনে করলেও আমাদের ছাড়ে না। অনেক সময়ে আমরা ভাবি আমরা চোক্‌ কাণে দেখছি শুনছি, নাকে মুখে শুকছি, চাকচি, চামড়ায় মনে ছুঁচ্ছি ভাবছি তাহাই সত্য আর যা দেখতে, শুঁকতে, চাক্তে, ছুঁতে ভাবতে পারা যায় না সেই গুলি মিথ্যা। এখেনেই তো গোলমালটা বেড়ে গিয়ে ধ্যান কর্ব্বে কারা এই ভাবনাটাই ধ্যান ঘুরিয়ে দিল। জড়ের সাকারেরা ধ্যান করবে, না, জড়ের নিরাকারেরা ধ্যান কর্ব্বে? আর ধ্যান কারা করাবে? সাকারের মধ্যে সকলেই যে ধ্যান কর্ত্তে পারে তাতো আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। যারা ধ্যান করতে পারে না বলে বুঝে রেখেছি তাদের জড় বলি আর যেখানে যেখানে ধ্যান করতে পারে দেখছি সেখানে সেখানে জড়ের বদলে চেতন বলি। তা'হলেই আমাদের মত চেতনকে জড়ের থেকে ভিন্ন সম্প্রদায় করে ফেলছি। আমরা বাধ্য হয়ে এখন মনে করছি জড়ের সাকার বা নিরাকারেরা ধ্যান করে না। যেখানে জড়তা সেখানে জড়ের দ্বারা ধ্যান নাই। চেতন সাকার হউক্ বা চেতন নিরাকার হউক্ তাহাদের জড়ধৰ্ম্ম নাই বলিয়াই ধ্যান করিতে পারে। সংসারে থাক্তে হলেই এই সব বিচার পরমার্থ আলোচনার মধ্যে আমাদিগকে ক্রমশঃই প্রবেশ করাইয়া দেয়। যে সব কথা উঠিল সেই সব কথার আলোচনা কর্ত্তে হলেই “গৌড়ীয়” সাময়িক পত্র পড়তে হলো অন্ততঃ নিজের পুরণো ধ্যানটা বজায় রাখবার জন্য, কথা কাটাকাটির জন্যও গৌড়ীয় পড়বার কৌতূহলটা বৃদ্ধি হলো অথবা কথাটা 'ভাল করিয়া জানাটা আবশ্যক বলিয়া মনে হইল।


ধ্যান কারা করাবে ভাবতে গিয়ে আমরা দেখছি চেতনময় সাকার প্রাণীরা আমাদের ধ্যানের উদ্বেগ করায় আবার জড়ময় নিরাকার ভূতপেতনীরাও আমাদের ধ্যান করায় এছাড়া আমরা নিজে নিজে পূর্ব্বস্মৃতি লইয়া চিন্তা করিতে ছাড়ি না। আমরা নিজেদের কখন জড় মনে করি, জড় হইতেই নিজেদের কখন আমাদের চেতন ধৰ্ম্ম জন্মিয়াছে মনে করি আবার কখনও চেতনের অস্তিত্ব পূর্ব্বের থেকে ছিল মনে করি, হালের জড়ধারণা চেতন থেকেই হয়েছে মনে করি, জড় শরীরটা পড়ে গেলে চেতনই থাকে মনে করি। এখন দেখুন “গৌড়ীয়ের” সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই এসকল কথার ভাবনা আপনা থেকেই মনোমধ্যে জেগে উঠবে। এক সময় কতগুলো শীতে কষ্ট পাওয়া, নেংটিওলা সন্ন্যাসী জঙ্গলের নিকট বর্ষাকালে চান্ কর্ত্তে গিয়ে দেখলে যে একটা কম্বল নদীর মধ্যে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। তাদের একজন তাড়া- 'তাড়ি সেই মালিকহীন কম্বলটী নিজে যোগাড় করিতে গিয়া নদীর মধ্যে কম্বল ছুঁইবামাত্র কম্বলরূপী ভাল্লুক তাহাকে জড়াইয়া ধরলো। তীরে দাঁড়াইয়া সন্ন্যাসীকে অপরে বলতে লাগিল কম্বল ছেড়ে দাও, তখন ভালুকের নখে আক্রান্ত 'ও জর্জ্জরিত হইয়া সন্ন্যাসী বল্লেন আমি তো কম্বল ছেড়ে দিইচি কিন্তু কম্বল তো আমাকে ছাড়ছে না। এগনষ্টিক সম্প্রদায় বা অজ্ঞেয়তাবাদী ঈশ্বর জড়ময় বলিয়া কিছুই জানা যায় না এরূপ পরমার্থ বিষয়ে উদাসীন থাকিলেও পরমার্থ তাঁহারা ধ্যানের বিষয় হইতে বাদ দিতে পারেন না। ভগবান্ তাঁহাকে সেই সেই বিষয় না দিয়া বা দিয়া তাহা হইতে বঞ্চিত করেন। “গৌড়ীয়” কে পারমার্থিক মনে করিলে পরমার্থের কথা তিনি সর্ব্বদাই বলিয়া ফেলেন ধারণা হইবে। আমরা সর্ব্বদাই বিষয় কথা ভালবাসী সুতরাং গৌড়ীয়কে আমাদের বিচারের বিষয় জানিয়াও তাহার সঙ্গ করিলে বস্তু ধর্মক্রমে আমাদের পরমার্থ আলোচনা হইবে। আর পারমার্থিক না জানিয়া বিষয়ী মনে করিলেও সংসারের জালানী কাঠের মত কার্যে পাওয়া যাইবে। যাঁরা পরমার্থ আলোচনা করতে ভালবাসেন না তাঁহারা গৌড়ীয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষাদি প্রামাণিক দার্শনিক কথা পাইবেন, যাঁরা মুমুর্ষু তাঁরাও সংসার বন্ধ মোচনের কথা, বৈরাগ্যের কথা প্রভৃতি প্রাণ ভরিয়া পাইতে পারিবেন। আবার যাঁহারা সংসারের ধর্ম, অর্থ ও কামনার কথা চান তাঁহারাও গ্রাম্য সংবাদ সমূহ ইহাতে ইতিহাস, কৃষি, বিজ্ঞান, শিল্প দর্শনাদি নানা- প্রকার অবলম্বন আর তাঁহাদের নিজের প্রকৃত পরিচয়ে জগতের সর্ব্বত্র এবং জগতের বাহিরে পরব্যোমের সর্ব্বত্র গতিবিধি আছে। গৌড়ীয়ের কথাগুলি বিশ্ববাসী জনসাধারণ কৃপা করিয়া শ্রবণ করিলে তাঁহারাও আপনাদিগকে পারমার্থিক গৌড়ীয় বলিতেই সুখ বোধ করিবেন। গৌড়ীয়ের সুহৃদয় সর্ব্বসমন্বয়তা সার্ব্বজনীন উদারতা ও অলৌকিক প্রেমে চতুর্দ্দশ ভুবনময় সমগ্র জগৎ ও পরব্যোম প্রদেশ আপ্লুত। তাহাতে মাৎসর্য্যের ঘৃণাক্ষরে কোন সম্বন্ধই নাই। সুতরাং গৌড়ীয়ের আবির্ভাব বড়ই আদরের।

Comments


bottom of page