অকৈতব সত্যের অনাবৃত প্রকাশ ও নিন্দামূলক সমালোচনা আদৌ এক নয়
শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গৌ জয়তঃ
অকৈতব সত্যের অনাবৃত প্রকাশ ও নিন্দামূলক সমালোচনা আদৌ এক নয়
(কৃষ্ণভক্ত শয়তানের শয়তান)
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত বিচারে দেখা যায় যে,--
“নিরপেক্ষ না হইলে ধর্ম্ম না যায় রক্ষণে।” অর্থাৎ নিরপেক্ষ ভূমিকায় না গেলে ধৰ্ম্ম (ভাগবত ধর্ম্ম) নীতি রক্ষা করা সম্ভব হয় না। গৌড়ীয় গোষ্ঠী পতি শ্ৰীশ্ৰীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদ পরমহংস জগদ্ গুরু জানিয়েছেন যে,- “আমি আপনাদের অনেক উদ্বেগ দিয়েছি। আপনাদের নিষ্কপট হরিভজনে নিয়োজিত করতে চেয়েছিলাম বলে আপনারা অনেকেই আমাকে শত্রু বলে মনে করে নিয়েছেন। একথা আপনারা কোন না কোন দিন বুঝতে পারবেন।” পরম কল্যাণের কল্পতরু পরমহংস বর শ্রীল প্রভুপাদ জানিয়েছেন, যে– “যদি সমগ্র জগৎ আমাকে ছেড়ে চলে যায়, এমন কি যারা আমার কাছে আসার (অর্থাৎ আশ্রয় নেবার) অভিনয় করেছে তারাও যদি সকলেই একে একে আমাকে ছেড়ে চলে যায়, তথাপি আমি শ্রীগুরুচরণের ছত্র ছায়ায় দাঁড়িয়ে ঐ পরম সত্যের কথা নির্ভীক ভাবে কীর্তন করতে পিছু পা হব না।” তিনি আরো জানিয়েছেন যে,–“লোক প্রিয়তা অনুসন্ধান ও শ্রীভগবানের সুখানুসন্ধান এক কথা নয়। লোক প্রিয়তা অনুসন্ধানের নাম অভক্তি বা অশ্রৌত পন্থা এবং শ্রীভগবানের সখানুসন্ধানের নাম ভক্তি। পরম পূজ্যচরণ আচার্য্য কেশরী— শ্রীশ্রীল ভক্তি প্রজ্ঞান কেশব গোস্বামী মহারাজ জানিয়েছেন যে,– “নিরপেক্ষ না হইলে ধর্ম্ম না যায় রক্ষণে’— শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের এই নিছক সত্য কথা পালন করতে গিয়ে যদি আমাকে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়—তথাপি ঐ বিপদের মুখোমুখী হেেয়ও জগৎকে চরম আদর্শ শিক্ষা দেওয়া উচিত।” আমার গতপ্রায় জীবনের অবশিষ্ট অংশটুকুও যেন সকল গুরুবর্গ তথা সকল গুরু-বৈষ্ণবগণের কৃপায় অকৈতব গৌর বাণীর সেবাতেই নিয়োজিত থাকে—এই সকাতর প্রার্থনা। আপনারা মহানুভব বৃন্দ যদি এই পরম শুভ কৰ্ম্মে আমাকে অমায়ায় প্রেরণাদেন, তবে আমি আমার জীবন সার্থক বিবেচনা করি। “নিরপেক্ষ না হইলে ধৰ্ম্ম না যায় রক্ষণে”—শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের ঐ নিছক সত্য কথা পালন করতে গিয়ে আমাকে বহু বহু ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে, তথাপি কখনই পিছুপা হইনাই। অনেকেই আমাকে বাহ্য দৃষ্টতে শত্রু ভেবে বিপথে চলে গছে। নিতান্ত মায়াবদ্ধ জীবগণ সকলেই সদ-অসদ বিবেক বৰ্জ্জিত তথা ভক্তি চক্ষু শূন্য এবং কেউ কেউ বা কেবল মায়া বিচিত্রতায় আবদ্ধ, আবার কেউ কেউ বা বহির্মুখ জ্ঞানের আশ্রয়ে চরম বিনাশের প্রত্যাশী। এমতাবস্থায় বদ্ধজীবের চরম দুর্গতি দর্শনে আমি বড়ই মুহ্যমান দশায় উপনীত । সত্যই এ বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয় তথা দুঃখের বিষয় বটে যে, সাম্প্রদায়িক অর্থাৎ সমগ্র সারস্বতঃ গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরা বা সম্প্রদায়ের স্বার্থ তথা মর্য্যাদা সংরক্ষণ কল্পে আমি শ্রীগৌড়ীয় গুরু বর্গের আদেশে নিতান্তই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ফলে স্বাভাবিকভাবেই অপস্বার্থ পর জনগণ আমাকে বিষাক্ত নজরেই দেখে থাকে এবং অপমান-অপদস্ত করতে চায়, কিন্তু তারা একথা জানেন না যে, আমি ‘তুল্য নিন্দা স্তুতি' বিচারে অবস্থিত হয়েই সকলের পরমহিত সাধনকারী সেবা ব্রতে জীবন উৎসর্গ করেদিয়েছি, ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোন বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ভাব আমার হৃদয়ে উদিত হওয়া আদৌ সম্ভব নয়, মহা আনন্দই আমার অদম্য সেব প্রেরণার উৎস। কেউ বলে থাকে শ্যাম বাবা জিনিয়াস, অথবা কেউ বলে জানুয়ার, কিন্তু এতে কোন রূপ প্রতিক্রিয়া আমার হৃদয়ে আদৌ স্থান পায় না। কেবল মাত্র এটাই বড় আপশোসের কথা যে, যাদের পরম মঙ্গলের জন্য আমার এই অহর্নিশ প্রয়াস-প্রচেষ্টা ও স্বর্থত্যাগ-তারাই আমাকে অকারণে মহাশত্রু ভেবে চির বঞ্চিত হয়ে গেল। তারা আমাকে অকারণে মহাশত্ৰু ভেবে চির বঞ্চিত হয়ে গেল। তারা এই সামান্য কথাটা অনুভব করতে পারেনি বা পারছে না যে আমি অনায়াসেই বিপুল লাভ-পূজা-প্রতিষ্ঠার ভাণ্ডার লুট করতে সমর্থ হয়েও কিন্তু আদৌ ঐ পথে পা বাড়াই নি, অর্থাৎ কোন সময়ই মায়ার বৈভব আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। গুরু কৃপা বিনা তা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু হায়! যারা এই অজ্ঞানে অচ্ছন্ন সমাজকে বোকা বানিয়ে তা'দেরকে নিজ নিজ লাভ পূজা প্রতিষ্ঠা সংগ্রহের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়ে মায়াদেবীর বঞ্চনাময় অবিদ্যা বা অজ্ঞানের গর্তে তাদের নিক্ষেপ করে চির বঞ্চিত করে দিল (এবং আজ তারা মহাসর্বনাশের পথের পথিক হয়ে গেল)। তারাই এখন কার দিনে মহান সাধু রূপে চিহ্নিত হয়ে গেল। আমি যে তাদের এতবড় স্নেহ ময় কড়া কড়া কথা শুনিয়ে কত বড় বন্ধুর কার্য্য করতে চেষ্টা করেচলেছি— এ ব্যাপারে তাদের কোন হুঁশই নেই। ধন্যকলির এই নিষ্ঠুর তামাশা দেখেও নিরাশ হতে পারি না, কারণ সাক্ষাৎ শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী এই যে,– “ভক্তিবিনোদ দারা কখনও অবরুদ্ধ হবে না।” নিত্যানন্দকে (বা নিত্য সত্যকে) গোপন করা বা ধ্বংস করা আদৌ সম্ভব নয়। এটা কোন নূতন কিছু নয়, কারণ যুগে যুগে পরমসত্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা অভিযান চলেই আসছে, নচেৎ কংস কেন কৃষ্ণকে ধ্বংস করতে চাইবে অথবা রাবণ কেন ভগবদশক্তি সীতাদেবীকে হরণ করতে যাবে, কিংবা হিরণ্য কশিপু কেন প্রহ্লাদ মহারাজকে মারতে যাবে। ছাত্র সংঘ কেনই বা শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে পেটাতে চাইবে, কেনই বা শ্রীল হরিদাস ঠাকুরকে মুসলমান মুল্লুক অধিপতি ২২ বাজারে চাবুক পিটিয়ে মেরে ফেলতে চাইবে, কেনই বা শ্রীল প্রভুপাদকে সময়ে সময়ে আক্রমণের ষড়যন্ত্র করেমেরে ফেলতে চাইবে, কেনই বা কাজী সংকীর্তন বন্ধ করে খোল ভাঙতে চাইবে। — ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর কিন্তু একটাই, সেটা এই যে-পরম সত্য বস্তুকে তারা কেউই চায় না। সকলেই মিছে মায়ার বসে যাচ্ছে ভেসে খাচ্ছে হাবু ডুবু ভাই। শ্রীল প্রভুপাদ বলেন যে পরম সত্য বস্তু এত সস্তা নয় যে তাঁকে গণআন্দোলন বা উচ্চ চিৎকার অথবা লোক বল কিংবা অর্থবলের দ্বারা তাঁকে মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে অথবা তাঁকে গলাটিপে হত্যা করা যাবে। যে পরমসত্য বস্তুর জন্য আমার জীবন উৎসর্গীকৃত, সেই সত্যবস্তু স্বয়ংই আমার রক্ষা কর্তা। কোন হোমরা চোমরা নেতা হোতা বা ধনবান জন আমার রক্ষা কর্তা নয়। যিনি নিজেকে জয় করতে সমর্থ নয়, তিনি কিভাবে বিশ্বজয় করতে পারেন প্রচারের দ্বারা ! এটাই এখন বিশেষ ভাবে বিবেচ্য বিষয়। সাধারণ জনগণকে বোকা বানিয়ে দেওয়া খুবই সহজ, কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদের সিদ্ধান্ত বিচারকে ফাঁকি দিয়ে কোনদিন কেউ বাস্তব সাধুত্ব লাভ করতে পারে না। বাস্তব সাধুত্বে অপ্রাকৃত সহজ সরল ভাব থাকে। গৌড়ীয়গণের অপ্রকৃত বৈদান্তিক আচাৰ্য্য বৰ্য – শ্রীশ্রীল স্বরূপ গোঁসাইয়ের সিদ্ধান্ত বিচারের কন্ঠী পাথরে পরিক্ষিত ও অনুমোদিত না হতে পারলে আমাদের সকল বাহাদূরী বৃথা হয়ে যায়। শ্রীল প্রভুপাদ বড়ই দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছেন যে,– “হরি কথার (বা হরিভজনের নামে) নামে বর্তমান কালে যাঁরা লোককে বিপথগামী করছেন, তাদের নিকট হতে বঞ্চিত হওয়াই বর্তমানের একটা যুগধৰ্ম্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।” তিনি আরো জানিয়েছেন যে,– “নির্ভীক হয়ে যে নিরপেক্ষ সত্য বলা হচ্ছে, শত শত জন্মপরেও শত শত যুগপরেও কেউ না কেউ ইহার নিগূঢ় সত্য (রহস্য) বুঝতে পারবে। কষ্টার্জিত শত শত গ্যালন রক্ত ব্যয়িত না হওয়া পর্য্যন্ত একটি লোককে সত্য কথা (অর্থাৎ পরম সত্যের বিষয়) বোঝান যায় না।” জীবনের হিসাব কিতাবে কোথায় যে ভুল থেকে যাচ্ছে তা কেউই বুঝতে পারছে না। হিমালয়ের মাউন্ট এভারেষ্টের উচ্চ শিখর সদৃশ উচ্চপ্রতিষ্ঠার শিখর থেকে গড়ান পথে যখন কারও পতন হয়, তখন সে প্রতিষ্ঠার অভিমানে তা বুঝতে পারে না ।
Comments