মঠ কি?
মঠ কি?
( ২৪সে চৈত্র ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, ইং ১০ই মার্চ্চ ১৯২৩ খৃষ্টাব্দ, শনিবারের “গৌড়ীয়” ১ম বর্ষের ৩২শ সংখ্যায় শ্রীগৌড়ীয় মঠ হইতে পুর্ব্ব প্রকাশিত)
যেখানে শুদ্ধ জ্ঞানলাভের জন্য জীবগণ শ্রীগুরু-পদাশ্রয় করেন সেই স্থানকে মঠ কহে। কৰ্ম্মিগণ শ্রীশাক্যসিংহ গৌতমের আশ্রয়ে কতিপয় আনুষ্ঠানিক কৰ্ম্মমঠ স্থাপিত করিয়াছিলেন। সেই সকল মঠে কর্মপদ্ধতির আদর এবং অনুষ্ঠানবিরত শ্রমণগণ বাস করিতেন। শাক্যসিংহের উদয়কালের বহুপূর্ব্বে বনবাসী ঋষিগণের আশ্রয়ে ব্রাহ্মণ-বটুগণ বেদশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখাধ্যয়নের জন্য বাস করিতেন। ক্রমশঃ তাদৃশ আশ্রমগুলি কর্মপদ্ধতি মতে দেবালয়ে পরিণত হইয়াছিল। শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লিখিত আছে যে, বনবাস সাত্ত্বিক, গ্রামবাস রাজস, ক্রীড়াগৃহ বা আখড়াবাড়ী তামস এবং ভগবদ্গৃহ নির্গুণ। কর্ম্মিগণ যে কালে গুণরহিত হইয়া নির্গুণ বিষ্ণুর অপ্রাকৃত বিগ্রহেয় সেবন করেন সেই সময়ে তাঁহাদের আর বহ্বীশ্বরবাদের মধ্যে প্রবেশ করিতে হয় না। কর্মিমঠ, দেবালয় ও শ্রমণগণের আবাস- স্থলীভেদে দ্বিবিধ, এই জন্যই ব্রাহ্মণগণ গুরুমঠে বাস করায় ‘দেবশর্মা’ নামে অভিহিত হন এবং বৌদ্ধসন্ন্যাসিগণ ‘শ্রমণ’ শব্দে অভিহিত। বৈদিকানুষ্ঠানপর কর্মিগণ, বৌদ্ধশ্রমণগণের সহিত পার্থক্য স্থাপন বাসনায় গুরুগৃহ, দেবালয়ে বাস করায় দেবশর্ম্মণ হইতেন আর বৌদ্ধগণ বেদবিরোধী হইয়া উদাসীন জীবনে অবস্থিত হইলেও তাঁহারা নাস্তিক শ্রমণ নামে অভিহিত হইতেন। কর্ম্মিমঠে বেদশাস্ত্র এবং কোথাও কোথাও বেদবিরুদ্ধ শাস্ত্র পঠন পাঠনাদি চলিত।
কর্মি-সন্ন্যাসীগণ নানাস্থানে ভ্রমণপরায়ণ হওয়ায় তাঁহাদের বহ্বীশ্বরবাদের দেবমন্দিরগুলি ক্রমশঃই অনাদৃত হইয়া কালের করাল গর্ভে নিপতিত হয়। সেই কালে নৈষ্কৰ্ম্মবাদিগণের নালন্দ মঠাদি বহু
নাস্তিক ছাত্রের আশ্রয় স্থল হইয়াছিল। শ্রীশঙ্করাচার্য্যপাদের অব্যবহিত পরবর্তীকালে ভারতের চতুর্দিকে তাঁহার শিষ্যগণ তাঁহার প্রচারিত মত সংরক্ষণের জন্য চারিটী মঠ স্থাপন করেন। কাল- প্রভাবে তাহাও ন্যূনাধিক বিপন্ন হইয়াছে। এই জ্ঞানী মঠগুলিতে বেদান্ত শাস্ত্রের অক্ষুন্নধারা অবলম্বন করিয়া পঠন-পাঠনাদির কথা ভারতের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে প্রমাণ দিবে। শঙ্করের পরবর্তী কালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে জ্ঞানী মঠ স্থাপিত হইয়াছে। তথায় বহু বিষয়-বিরক্ত যতীন্দ্রগণ অধ্যাপনা কার্য্যে স্ব স্ব জীবনোৎসর্গ করিয়াছেন। শৃঙ্গবেরপুরে যে প্রসিদ্ধ শঙ্করমঠ আছে, তাহা হিন্দু-জন-সাধারণ বিশেষ গৌরব-চক্ষুদ্বারা সন্দর্শন করেন। দ্বারকা মঠ বা সারদাপীঠেও জ্ঞানীমঠ-গৌরব ন্যূনাধিক সংরক্ষিত হইয়াছে। পূর্ব্ব সমুদ্রকূলে শ্রীপুরুষোত্তমেও ভোগবর্দ্ধন বা গোবর্দ্ধনমঠ এক সময়ে বিলুপ্ত হইলেও বর্তমান কালে তাহার প্রাচীন প্রভাব আলোক বিকিরণে পশ্চাদপদ নহে। জ্যোতিৰ্ম্মঠ বা জ্যোষিমঠ আজ তিন চারিশত বৎসর হইতে এক প্রকার বিলুপ্ত হইয়াছে। জ্ঞানীমঠগু’লর অধিষ্ঠানই ভারতীয় জ্ঞানকাণ্ডের প্রাচীন স্তম্ভ সদৃশ।
কর্মী ও জ্ঞানীগণের মঠ ব্যতীত ভক্তিপথের কতিপয় প্রাচীন মঠ অদ্যাপিও বেদের উপাসনা কাণ্ডের কীর্ত্তিবহন করিতেছেন। শ্রীরামানুজীয় ত্রিদণ্ডী মঠ সমূহ, একদন্ডী উড়ুপীস্থ শ্রীমাধ্বমঠ সমুহ 'পঞ্চনদ প্রদেশে কাসুরে বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ের মঠ ও শ্রীনিম্বাদিত্য সম্প্রদায়ের কতিপয় মঠ আজও বৈদিকমত পোষণোদ্দেশে ভজনকারীর আশ্রয়রূপে সনাতন ধর্ম্ম রক্ষা; করিতেছেন। শ্রীমাধ্ব-গৌড়ীয়-গণের শ্রীবৃন্দাবনস্থিত শ্রীগোবিন্দ, গোপীনাথ, মদনমোহনের মঠত্রয়; বৈদেশিক বৈরিতায় ক্ষুব্ধ হইলেও পূর্ব্ব সমুদ্রোপকূলে শ্রীবক্রেশ্বর পণ্ডিত শাখার শ্রীরাধাকান্ত মঠ, শ্রীগদাধর পণ্ডিত শাখার গঙ্গামাতা মঠ, শ্রীশ্যামানন্দ শাখার কুঞ্জমঠ প্রভৃতি পূর্ব্ব গৌরবের দীপ সমূহ নির্ব্বাণোম্মুখ হইতেছে। মঠ সমুহের বৈদিক গৌরব, শাস্ত্রীয় গৌরব, আনুষ্ঠানিক গৌরব ন্যূনাধিক বিপন্ন হইলেও প্রতিষ্ঠাতার উদ্দেশ্য কিয়ৎপরিমাণে নষ্ট হইলেও মঠের নাম মাত্র কালের সাগরে একেবারেই ভাসিয়া যায় নাই। গৌড়ীয়ের পাঠকবর্গ গৌড়ীয়ের মুখপত্রে কতিপয় মঠাদির বিবরণ পাঠ করিয়া থাকেন। যাহাতে প্রাচীন মঠগৌরব অক্ষুণ্ণ থাকিয়া শ্রীমন্মহাপ্রভু প্রচারিত শিক্ষামন্দির সমূহের পুনরায় বিজয় বৈজয়ন্তী শোভিত হইতে পারে তৎপক্ষে নির্ব্ব্যলীক সাধুগণের চেষ্টা সর্ব্বতোভাবে প্রার্থনীয়।
ভক্তিমঠের অধিবাসিগণ কিছু পণ দ্রব্য বিক্রেতা বিপণিপতি নহেন। তাঁহারা ঠিকাদার বা চুক্তিদার নহেন, তাঁহারা ভূতকাধ্যাপক নহেন, তাঁহারা পুস্তকবিক্রেতা নহেন, সংসারযাত্রা নির্ব্বাহোপযোগী আত্মীয় স্বজনের পরিপোষ্টা নহেন। তাঁহাদের অর্জ্জনের বৃত্তি ভিক্ষা। এবং সেই ভিক্ষা দ্বারা তাঁহারা কেবলমাত্র নিজেদের উদর ভরণ, আত্মীয় স্বজনের উদরভরণ, বিলাসসৌষ্ঠবের ব্যয় নির্ব্বাহ প্রভৃতি হরিভজনের প্রতিকূল কার্য্যে কোন অর্থই ব্যয় করেন না। বিভিন্ন আশ্রমের বিভিন্ন অবস্থার ব্যক্তি হইলেও মঠ সেবার ভিক্ষালব্ধ অর্থ অবান্তর কার্য্যে ব্যয়ের পক্ষপাতী নহেন। পক্ষান্তরে তাঁহাদের নানাপ্রকারে শ্রমলব্ধ অর্জ্জিত অর্থ মঠের সেবা-কার্য্যেই ব্যয়িত হইতেছে। মঠের আনুকূল্য দাতৃবর্গের এইরূপ বিচার হওয়া কর্ত্তব্য যে, মঠসেবকগণ অনেকেই সর্ব্বস্ব এবং কেহ কেহ কায়মনোবাক্যের অপেক্ষাকৃত অধিকাশংই হরি-সেবায় নিযুক্ত করিয়াছেন এবং সমগ্র জগতের নিকট হইতে আংশিক আনুকূল্য গ্রহণ করিতেছেন মাত্র। আনুকূল্যদাতৃগণ, মঠকে দোকান এবং মঠসেবকগণকে তাঁহাদের ঠিকাদার বা ভৃত্য জ্ঞান না করিয়া,সত্য সত্য হরিগুরুবৈষ্ণবসেবোদ্দেশ্যে
হরিসেবার সাহায্য করেন ইহাই প্রার্থনীয়। ইহাতে তাঁহাদের প্রত্যাকার হইবে না। সাধারণ সৎকার্য্যবোধেও তাঁহাদের প্রদত্ত ভিক্ষা জগৎপাতার, সমাজনিয়ন্তার সেবায় নিযুক্ত হইলে তাহাতেও তাঁহারা শতগুণ ফললাভ করবেন।
Comments